বৌদ্ধ ধর্ম

সদস্য ব্যাজ স্তরে ইতােপূর্বে তােমরা ঈশ্বরের মহাত্মসূচক স্তবস্ত্রোত্র ও প্রার্থনা, বুদ্ধ বন্দনা, ধর্ম বন্দনা, সংম বন্দনা, কঠিন চীবর দান, প্রবারণা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাজ বইয়ের উপােসথ, আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ, প্রােগ্রেস ব্যাজ স্তরে শীল, পঞ্চাশীল প্রার্থনা, ত্রিশরণ, পঞ্চাশীল, অষ্টশীল প্রার্থনা, দশশীল প্রার্থনা ও দশশীল সম্পর্কে শিখেছ। এই স্তরে নিম্নোক্ত বিষয় সম্পর্কে শিখবে ও অনুশীলন করবে।

চতুরার্য সত্য : সুখ ও দুঃখ মানুষের জীবনে আলােছায়ার মত দৃশ্যমান। ধূলার ধরণীতে সুখের চেয়ে দুঃখের মাত্রাই অধিক। শাস্ত্রে বলা হয়েছে –

দুখমেব হি সম্ভোতি দুখং তিঠতি বেতি চ,

নাঞঞএ দুকখা সম্ভোতি নাঞঞং নিরুজ্ঝতী’তি।

জগতে কেবল দুঃখ সত্যেরই উৎপত্তি ও বিলয় হয়।

দুঃখ ব্যতীত অপর কিছু উৎপন্ন হয় না, নিরােধও হয় না।

জগতে সুখানুভূতি বিদ্যুঝলকের মত মানুষের মনোেরাজ্যে অস্থায়িত্বের চিহ্ন এঁকে দেয়। তা স্থায়িত্বের বেদনায় পীড়িত। মানব জীবন যেন এক দুঃখের সমুদ্র। সেই সমুদ্রের তরঙ্গ জীবন বেলাভূমিতে নিরন্তর আছড়ে পড়ে। দুঃখানুভূতির মর্মদাহে জীবন প্রতিনিয়তই দগ্ধ হচ্ছে। জননী জঠর থেকে আমৃত্যু অসংখ্য কামনা বাসনার অপূর্ণতায় তাকে দুঃখের ঘনান্ধকারে ডুবিয়ে রাখে।

জগৎ নিরবিচ্ছিন্ন দুঃখময়। এটি বঙ্গ-ভারতীয় দর্শনের স্বীকৃত সত্য। ভগবান বুদ্ধ একে এক বাস্তব সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কারও কারও মতে সংসারে সুখও আছে। কিন্তু সেই সুখ ক্ষণস্থায়ী, সুখের পরিণাম দুঃখজনক। অদূরদর্শীর নিকট দুঃখও কোন কোন সময় সুখরুপে প্রতিভাত হয়।

অমধুরং মধুরুপেন প্রিয়রুপেন অপিয়ং

দুখং সুখস্স রুপেন পমত্তং অতিবত্ততি

অমধুর মধুররূপে, অপ্রিয় প্রিয়রূপে এবং দুঃখ সুখরূপে মূঢ় ব্যক্তির নিকট প্রতিভাত হয়। সুতরাং সাময়িক সুখও পরিণামে দুঃখকর।

যুগে যুগে মহাপুরুষগণ দুঃখের এ সর্বগ্রাসী প্রভাব থেকে পরিত্রাণ লাভের চেষ্টা করেছেন। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর পূর্বে কপিলাবস্তুর রাজকুমার সিদ্ধার্থ বা গৌতম রাজকীয় বিলাসব্যসন ত্যাগ করে-এ দুঃখ মােচনের সন্ধানে কঠোর পরিশ্রম করেন। জন্ম জন্মান্তরের সাধনা, ত্যাগ ও তিতিক্ষার দ্বারা তিনি যে সত্য উপলব্ধি করেন তাকে সংক্ষেপে “চতুরার্য সত্য” বলা হয়। এ চতুরার্য সত্যের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের সারতত্ত্ব নিহিত। বুদ্ধ নিজেই বলেছেন, “চতুসচ্ছাে বিনিমুত্তো ধম্ম নাম নথি”। অর্থাৎ, চতুরার্য সত্য ব্যতীত অপর কোন ধর্ম নেই।

চতুরার্য সত্য নিম্নরুপ :

  • দুঃখ আর্যসত্য।
  • দুঃখ সমুদয় আর্যসত্য।
  • দুঃখ নিরােধ আর্যসত…
  • দুঃখ নিরােধের উপায় আর্যসত্য।

দুঃখ আর্যসত্য : দুঃখ বহু প্রকার। যেমন-জন্ম দুঃখ, বার্ধক্য দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মৃত্যু দুঃখ, শােক-পরিতাপ, দুর্মতা ও উপায়াস দুঃখ, অপ্রিয় সংযােগ ও প্রিয়বিয়ােগ দুঃখ, ঈম্পিত বস্তুর অপ্রাপ্তি দুঃখ, পঞ্চ উপাদান স্কন্ধ দুঃখ।

“দুখা জাতি পুনপ্পনং”

অর্থাৎ পুনঃ পুনঃ জন্ম গ্রহণ করাই দুঃখ।

দুঃখ সমুদয় আর্যসত্য : এটাই দুঃখের কারণ। তৃষ্ণাই পুনর্জন্মের হেতু। এটি কামনাকে আশ্রয় করে উৎপন্ন হয়। তৃষ্ণা অনুরাগ সহগত হয়ে রুপ, রস, গন্ধ, শব্দ ও স্পর্শে আকৃষ্ট হয়। তাছাড়া এটি পুনর্জন্মকে আহ্বান করে। এ তৃষ্ণা ত্রিবিধকামতৃষ্ণা, ভবতৃষ্ণা ও বিভবতৃষ্ণা। জরা ব্যাধি, মৃত্যু, অপ্রিয় সংস্পর্শ, প্রিয় বিয়োেগ, ঈম্পিত বস্তুর অপ্রাপ্তিজনিত দুঃখ, তাকে আর ভােগ করতে হয় না। এটাই দুঃখ সমুদয় আর্যসত্য।

দুঃখ নিরােধ আর্যসত্য : তৃষ্ণার অবশেষ, বিরাগ, নিরােধ, ত্যাগ, বিসর্জন, মুক্তি, আশ্রয় নিরােধ বিহীনতা, নিবৃত্তিই নিরােধ সত্য। হেতু বশত মানুষ জন্মগ্রহণ করে। হেতু নিরদ্ধ হলেই জন্ম নিরুদ্ধ হয়। চক্ষু প্রসাদ, রুপালম্বন, চক্ষু বিজ্ঞান-এ তিনটির স্পর্শ হলে, মানুষ সুখ-দুঃখ অনুভব করে। সংস্পর্শ থেকে বেদনা বােধ হয়। বেদনা থেকে তৃষ্ণার উদ্ভব হয়। তৃষ্ণার কারণে উপাদান, উপাদনের কারনে কর্মভব সজ্ঞাত হয়। এভাবেই জন্ম জরা ব্যাধি, শােক, দুঃখ দৌর্মনস্য প্রভৃতি দুঃখের উদ্ভব হয়।

দুঃখ সত্য জ্ঞান অবশ্যম্ভাবী। দুঃখ সত্যে প্রকৃষ্ট জ্ঞাত হলেই মানুষ “নিরােধ” বা “নিবার্ণ” লাভ করতে সক্ষম হয়। দুঃখ নিরােধের অপর নাম নিরােধ সত্য।

দুঃখ নিরােধ গামিনী প্রতিপদা আর্যসত্য : আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গই দুঃখ নিবৃত্তির উপায়। এটি মােট আট প্রকার। যথা –

  1. সম্যক দুষ্টি,
  2. সম্যক সংকল্প,
  3. সম্যক-বাক্য,
  4. সম্যককর্ম,
  5. সম্যক আজীব,
  6. সম্যক ব্যায়াম,
  7. সম্যক স্মৃতি এবং
  8. সম্যক সমাধি।

0 0 votes
Article Rating
guest
67 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments