জাতীয় পতাকা

জাতীয় পতাকা উড়ানাের নিয়ম :

জাতীয় পতাকা দেশের পরিচয় বহন করে। এই পতাকা অত্যন্ত গৌরবের ও সম্মানের। নিজ দেশের গৌরব ও সম্মানকে অক্ষুন্ন রাখা এবং জাতীয় পতাকাকে সম্মান প্রদর্শন করা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। স্কাউটের বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অনুষ্ঠান ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা সঠিকভাবে উড়ানাে স্কাউটদের দায়িত্ব।

জাতীয় পতাকা সঠিকভাবে ও যথাযােগ্য সম্মান দেখিয়ে উড়াতে হয়। পতাকার ছােট দিকটা দণ্ডে সঙ্গে বাঁধা থাকে। লম্বা দিকটা উড়তে থাকে। রাতের বেলা জাতীয় পতাকা উড়ানাে হয় না। সাধারণত সূর্য ওঠার পরে পতাকা উড়াতে হয় এবং সূর্য অস্ত যাবার আগেই নামিয়ে ফেলতে হয়। উড়ানাে ও নামানাের সময় ইউনিফর্ম পরা স্কাউটেরা স্কাউট সালাম দেবে। অন্যরা সােজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।

জাতীয় পতাকার সঙ্গে অন্য কোন পতাকা উড়াতে হলে সেগুলাে ভিন্ন দণ্ডে জাতীয় পতাকার নিচে উড়াতে হবে। সাধারণত অন্যান্য পতাকা জাতীয় পতাকার দুইপাশে সমান দূরে দূরে থাকবে। দুইদিকের সংখ্যা সমান হতে হবে। তবে বেজোড় হলে বাম দিকে একটি বেশি থাকবে। উড়াবার সময় অন্যান্য পতাকা জাতীয় পতাকার আগে ওঠানাে যাবে না। আর নামাবার সময় জাতীয় পতাকা সকল পতাকার পরে নামবে। ময়লা, ছেড়া ও রং ওঠা পতাকা ব্যবহার করা যাবে না। জাতীয় সংগীত গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেও পতাকা উড়ানাে যায়। প্রত্যেক স্কাউটকে এ কাজটি সঠিকমত শিখতে হবে। জাতীয় পতাকা উড়ানাের পর যে রশির সাহায্যে পতাকা উড়ানাে হল সে রশির প্রান্তকে পতাকা দন্ডের সাথে বড়শি গেরাে (Clove Hitch) দিয়ে বাধতে হবে। জাতীয় পতাকা দড়ির সঙ্গে শীট বেন্ড (Sheet Bend) দিয়ে বাঁধতে হবে।

জাতীয় পতাকা উড়ানাের পদ্ধতি :

পতাকা উড়ানাের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ পৃথক লাঠি বা একই মাপ ও উচ্চতার পতাকা দণ্ড ব্যবহার করে থাকে। জাতীয় পতাকার মাপও প্রায় একই ধরনের। অধিকাংশ দেশ মনে করে যে, জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান দেখানাের জন্য এর অবস্থান অন্যান্য পতাকার মাঝখানে থাকবে। সাধারণত এর অবস্থান কোন ভবনের প্রধান প্রবেশ পথে প্রবেশকারী পর্যবেক্ষণকারীর বাম দিকে অন্য পতাকার ডান দিকে থাকে এবং একই সারিতে অনেকগুলাে পতাকার মাঝখানে জাতীয় পতাকা উড়ানাে হয় বা সারির যে কোন এক প্রান্তে অন্যান্য পতাকার উপরে থাকে।

ভবনে : লম্বা লাঠি বা পতাকাদন্ড অথবা দড়ির শীর্ষে জাতীয় পতাকা উড়াতে হবে যাতে পতাকার অগ্রভাগ ভূমি স্পর্শ না করে। পাশাপাশি দুটি পতাকা উড়াতে হলে জাতীয় পতাকা ডান পার্শ্বে থাকবে।

সড়কে : জাতীয় পতাকা লম্বা দন্ডে বা উচ্চ লাইট পােস্টে উপরে সােজা অবস্থায় ঝােলানাে থাকবে যাতে চলমান যানবাহনের ওপরে থাকে। একই পােস্টে আড়াআড়িভাবে স্থাপিত দন্ডে পতাকা উড়ানাের সময় জাতীয় পতাকা ডান পার্শ্বে থাকবে এবং জাতীয় পতাকা দণ্ড অন্য পতাকাসমূহের দন্ডের ওপরে থাকবে।

ভূমিতে : জাতীয় পতাকা সকল পতাকার আগে উত্তোলন করতে হবে এবং অন্যান্য পতাকার উপরে থাকবে।

ভবনে ব্যবহৃত পতাকার মাপ :

(ক) ভবনের সাইজ অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত মাপের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে হবে –

  • ৩ মিটার x ১.৮০ মিটার 
  • ১.৫ মিটার x ৯০ সে.মি.
  • ১.২৫ মিটার x ৪৫ সে.মি.

(খ) মােটর গাড়ীতে ব্যবহৃত পতাকার মাপ –

  • বড় ধরনের গাড়ীতে ৩৭.৫ সে.মি. x ২২.৮ সে.মি.
  • মাঝারী বা ছােট গাড়ীতে ২৫.৩ সে.মি. x ১৫ সে.মি.

(গ) আন্তর্জাতিক বা দ্বিপাক্ষিক সম্মেলন টেবিলে ব্যবহৃত পতাকার মাপ –

  • ২৫.৩ সে.মি. x ১৫ সে.মি.

জাতীয় পতাকা বিবর্তনের ব্যাখ্যা :

সদস্য ব্যাজ বইয়ে জাতীয় পতাকা তৈরি, অংকন, পদ্ধতি, পতাকার রং ও তার তাৎপর্য সম্পর্কে অবগত হয়েছে এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাজ বইয়ে পতাকার মাপ, জাতীয় পতাকার উড়ানাের নিয়ম ইত্যাদি ছাড়াও জাতীয় পতাকার বিবর্তণ সম্পর্কে আরাে কিছু জানবে। মানব সভ্যতার বিকাশের ধারায় আদিম মানুষ প্রয়ােজনের তাগিদে এক সময় দল বেঁধে চলতে শুরু করে। প্রাথমিকভাবে বন্য পশু থেকে আত্মরক্ষা ও শিকার করার উদ্দেশ্যে মানুষ দল বাঁধে। পর্যায়ক্রমে যখন আস্তে আস্তে সম্পদের স্বল্পতা দেখা দেয় তখন এক দলের সঙ্গে আর এক দলের লড়াই শুরু হয়। সে সময় দল বা টোটেমগুলাে বিভিন্ন পশুর নামে নামকরণ করা হত। টোটেমের সদস্যগণ উক্ত পশুর প্রতিকৃতি তাদের হাতিয়ারে অঙ্কিত করে নিত। কালক্রমে যুদ্ধের সময় উক্ত প্রতিকৃতি গাছের বাকল বা পশুর চামড়ায় এঁকে দলের পরিচয় বােঝানাের জন্য ব্যবহৃত হত। এটা হচ্ছে জাতীয় পতাকার আদিরূপ।

জাতীয় পতাকার ধারণা তৈরি হয় অষ্টদশ শতাব্দির শুরুর দিকে। প্রথমত যুদ্ধ বিগ্রহের সময় দেশের প্রতিক হিসেবে পতাকার ব্যবহার শুরু হলেও পরবর্তীতে জাতীয়তা বােধের প্রতিক হিসেবে জাতীয় পতাকার ব্যবহার দেখা যায়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা আমেরিকার বিপ্লবের পর ১৭৭৭ সালের নৌ সমরের প্রতিক থেকে তৈরি হয়েছে। ব্রিটিশ ইউনিয়ন ফ্ল্যাগও তৈরি হয়েছে সপ্তদশ শতকের নৌ সমরের প্রতিক থেকে, যদিও তা জাতীয় পতাকা হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৯০৮ সালে ।

খ্রিষ্টপূর্ব ১৯২২ অব্দে চীনের চৌ বংশের রাজত্ব কালে একটি সাদা পতাকা ব্যবহার করা হত। প্রাচীন ভারতে পতাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রথ বা হাতি কর্তৃক পতাকা বহন করা হত। ভারতীয় পতাকা ছিল সাধারণত ত্রিকোণাকৃতি, টকটকে লাল বা ঘন সবুজ রং, কোন প্রতিকৃতি সম্বলিত এবং ঝালর বিশিষ্ট।

ভারত ও চীনে পতাকা সংকেত প্রদানের কাজেও ব্যবহৃত হত। যুদ্ধের ময়দানে সাদা পতাকা প্রদর্শন করে যুদ্ধ বিরতির সংকেত দেওয়া হয়।

ইসলাম প্রবর্তনের পর মুসলিম জগতে পতাকায় জীব-জন্তুর প্রতিকৃতি ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। উমাইয়া আমলে সাদা, আব্বাসীয় আমলে কালাে পতাকা এবং ফাতেমীয় আমলে সবুজ রংয়ের পতাকা ব্যবহার করা হত। পর্যায়ক্রমে মুসলমানদের পতাকায় সবুজ রং অধিক ব্যবহার হতে থাকে এবং চাদ তারা ইসলামী প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশের রাষ্ট্রসমূহের পতাকায় সাধারণত সবুজ, হলুদ ও লাল রং লম্বালম্বি ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশের অনেক দেশে সবুজ, নীল, কালাে ও সাদা এর মধ্যে তিনটি রঙ সমান্তরালভাবে তাদের পতাকায় ব্যবহৃত হচ্ছে। পৃথিবীর সকল দেশের জাতীয় পতাকা রয়েছে। পতাকা দেশেরই পরিচয় বহন করে।

নিয়ম পদ্ধতি :

জাতীয় পতাকা মর্যাদা যত্ন সহকারে সংরক্ষন করতে হবে। কোন প্রকার ভুলের কারনে পতাকা পৃষ্ঠা ছিড়ে গেলে তা পরিস্কার করে ভাঁজ করে রাখতে হবে অথবা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, কোন ভাবেই পুড়ে ফেলা, ফেলে রাখা যাবে না।

স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতির সময় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ছিল সবুজ জমিনের মাঝখানে গােলাকার লাল সূর্য। লাল সূর্যের মাঝখানে ছিল সােনালি রংয়ের বাংলাদেশের মানচিত্র। স্বাধীনতা সগ্রামের সময় এই পতাকা ব্যবহার করা হয়।

স্বাধীনতা লাভের পর জাতি মনে করল যে পতাকার মাঝখানে দেশের মানচিত্র দেওয়া ঠিক নয়। তাই মাঝখান থেকে মানচিত্র বাদ দেওয়া হয়েছে। তৈরি হয়েছে বর্তমান পতাকা।


0 0 votes
Article Rating
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments