দড়ির কাজ

সদস্য ব্যাজের জন্য ৪ টি গেরাে সম্পর্কে জানা প্রয়ােজন হলেও দড়ির প্রকারভেদ, দড়ির যত্ন, দড়ি রাখার নিয়ম, দড়ির মুখ বাঁধা ইত্যাদি জানা অপরিহার্য। তাই ৪ টি গেরাে আলােচনার আগেই দড়ির বিভিন্ন বিষয় সমূহ নিমে আলােচনা করা হল –

(ক) দড়ির প্রকারভেদ সম্পর্কে জানা ও যত্ন সহকারে দড়ি গুছিয়ে রাখতে পারা :

দড়ি কি : হাজার বছর ধরে মানুষ দড়ির কাজ ও গেরাে ব্যবহার করে আসছে। এই প্রযুক্তির যুগেও গেরাের ব্যবহার থেকে থাকেনি। মাছ ধরা, নৌ-চালনা, পর্বতারােহের মতাে খেলাধুলা থেকে শুরু করে উদ্ধারকার্য, আগুন নেভানাে, অস্ত্রোপচারের মতাে জীবনরক্ষাকারী কাজসহ দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজে গেরাের ব্যবহার অস্বীকার্য।

দড়ির প্রকারভেদ :

লেইড রোপ (Laid Ropes) বা (Twisted Rope) –

প্যাচানাে দড়ি : প্যাচানাে দড়ি সাধারণত তিনটি সূতা/তন্তু দিয়ে তৈরি হয়, যা বাম থেকে ডানে প্যাচানাে থাকে। প্রাকৃতিক তন্তু দিয়ে এ দড়ি তৈরি হলেও বর্তমানে এ দড়ি তৈরিতে কৃত্রিম উপাদানের ব্যবহারও দেওয়া যায় ।

ব্রেইডেড রােপ (Braidded Rope) –

বিবুনি করা দড়ি : এ ধরণের দড়ির ভেতরকার অংশ শক্ত কৃত্রিম তন্তু দিয়ে তৈরি হয় এবং উপরের অংশে বেনী করা খাপ দিয়ে ঢাকা থাকে

এ ছাড়াও তৈরির উপাদান হিসেবে দড়িকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায় –

প্রাকৃতিক দড়ি (Natural Rope) : যা পাট, শন, নারিকেলের ছােবড়া, ম্যানিলা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হয়। প্রাকৃতিক দড়ি সাধারণত সস্তা হয়।

কৃত্রিম দড়ি (Synthetyic Rope) : নানা বস্তুর মিশ্রণে তৈরি হয় কৃত্রিম দড়ি, যা দীর্ঘ স্থায়ী, শক্ত ও মজবুত হয়। এ ধরণের দড়ির দাম অপেক্ষাকৃত বেশী ।

তারের দড়ি (Wired Rope) : ধাতব পদার্থকে তারের মতাে পেঁচিয়ে তৈরি হয় তারের দড়ি। ব্রীজ, লিফট এবং বিভিন্ন অবকাঠামাে তৈরিতে তারের দড়ি ব্যবহৃত হয়। স্কাউটরা সাধারণত এ ধরণের দড়ি ব্যবহার করে না।

দড়ির যত্ন : নানা কাজে স্কাউটরা দড়ি ব্যবহার করে থাকে। কোন কাজে দড়ি ব্যবহারের পর অনেক সময় দড়িতে নানা প্রকার কাদা, মাটি, শ্যাওলা বা ময়লা লেগে থাকতে দেখা যায়। এতে করে দড়ি সহজেই নষ্ট হয়ে যায়। দড়ি ব্যবহারের পরে ভালভাবে পরিস্কার করে রাখতে হয়। যদি ভেজা থাকে তবে রােদে শুকিয়ে রাখতে হবে। কোন দড়িটি কতটুকু লম্বা তা একটি কার্ডে লিখে ঐ দড়িতে বেঁধে রাখলে প্রয়ােজনের সময় নির্দিষ্ট মাপের দড়িটি খুঁজে পাওয়া সহজ হয়। দড়ি সাধারণত পেঁচিয়ে ঝুলিয়ে রাখলে ভালাে হয় এবং কিছুদিন পরপর দড়ি ঝেড়ে মুছে প্রয়ােজনে রােদে শুকিয়ে রাখতে হয়। তা না হলে ইদুর, উইপােকা অথবা অন্য কোন কীট-পতঙ্গ দড়ি নষ্ট করে ফেলতে পারে।

দড়ি গুছিয়ে রাখার নিয়ম :

১. দড়ির একটি প্রান্ত বাম হাতে ধরে ডান হাত প্রসারিত করে ডান হাতে দড়ির এক অংশ ধরতে হবে। এবার ডান হাতে ধরা দড়িকে আগে বাম হাতে ধরা দড়ির উপর রাখতে হবে। এতে করে হাতে প্রায় দু’হাতের সমান বৃত্ত হবে। এভাবে সমস্ত দড়ি বাম হাতে রেখে সর্বশেষ প্যাচটি ডান হাতে রেখে বাম হাতের প্যাচগুলাের ওপরের দিকে একবার ঘুরিয়ে পেছনের দিক থেকে বাম হাতের ফাকের ভিতর দিয়ে টেনে আনতে হবে। এবার যে বৃত্তটি তৈরি হলাে তা কোন ঝুলন্ত বাঁশ অথবা হ্যাংগারে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।

২. যদি দড়ি মােটা হয় তাহলে দড়ির এক প্রান্ত মাটিতে ফেলে একটি বৃত্ত তৈরি করতে হবে। এবার একই বৃত্তের চারদিকে ঘুরিয়ে একের পর এক বৃত্ত তৈরি করতে হবে। যেখানে শেষ হবে ঐ প্রান্তটি অন্য আরেকটি চিকন রশির সাহায্যে বেঁধে রাখতে হবে। যদি ঢিলে হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে তবে বৃত্তের তিন বা চারটি স্থানে চিকন দড়ি দিয়ে বেঁধে দড়ি সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

দড়ির বিভিন্ন অংশ : একটি দড়ির দুটি প্রান্ত থাকে। যে প্রান্তের সাহায্যে কাজ করা হয় তাকে চলমান প্রান্ত বলে । যে প্রান্ত ব্যবহার করা হয় না তাকে স্থির প্রান্ত বলে।

বাইট : দড়ির কোথাও যদি অর্ধবৃত্ত অথবা সােজা চলতে চলতে কোথাও বাকা হয়ে যায় অথবা যদি দড়ির এক প্রান্তকে দড়ির অপর অংশের পাশাপাশি রেখে প্রান্তে যদি লুপের মত তৈরি করা হয় তখন তাকে বাইট বলে।

টার্ন : কোন দড়ি দিয়ে কোন খুঁটিতে যদি একটি প্যাচ দেয়া হয় । তখন তাকে টার্ন বলে। টার্ন দেয়ার সময় দড়ির চলমান অংশ এবং স্থির অংশ পরম্পর একত্রে মিলিত হবে না।

রাউন্ড : কোন দড়ি দিয়ে কোন খুঁটিতে একটি পূর্ণ প্যাচ দেয়া হয় তাহলে দড়ির চলমান অংশ এবং স্থির অংশ একত্রে পরস্পরের সাথে মিলিত হবে। তখন তাকে রাউন্ড বলে ।

রাউন্ড টার্ন : কোন খুঁটিতে যদি দড়ির চলমান প্রান্ত দিয়ে একবার রাউন্ড এবং একবার টার্ন দেয়া হয় তখন তাকে রাউন্ড টার্ন বলে।

লুপ : দড়ির এক প্রান্তকে মূল দড়ির উপর রাখলে তা হবে লুপ। লুপ তৈরির সময় দড়ির চলমান অংশ দড়ির স্থির অংশের উপর অথবা নিচে থাকতে পারে। অনেক গেরাে আছে যা বাঁধার আগে লুপ তৈরি করে লুপের গেরাে বাঁধতে হয়।

(খ) হুইপিং (Whipping) বা দড়ির মুখ বাঁধা :

দড়ির মুখ খুলে গিয়ে তন্তু ছড়িয়ে পড়ে দড়ি যাতে কাজের উপযােগিতা না হারায় সে জন্য দড়ির মুখকে কোন সরু সুতা দিয়ে বেঁধে রাখার নাম হুইপিং বা মুখবন্ধ বলে। স্কাউটিংয়ে আমরা নিমলিখিত তিন ধরনের হুইপিং ব্যবহার করে থাকি । যথা –

  1. কমন হুইপিং (Common Whipping)
  2. ওয়েস্ট কাউন্ট্রি হুইপিং (West Country Whipping)
  3. সেইল মেকার্স হুইপিং (Sail Makers Whipping)

নিম্নে স্কাউটিংয়ে আমরা যেসব হুইপিং ব্যবহার করে থাকি তার মধ্যে সাধারণ হুইপিং বাঁধার কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আলােচনা করা হলাে।

(১) কমন হুইপিং (Common Whipping) : যে দড়ির মুখ বাঁধতে হবে সে দড়ির সাথে ৪০ সে. মি. একটি লম্বা সুতার এক প্রান্তে একটি বাইট তৈরি করে বাইটের অংশটি দড়ির মাথার কিছুটা উপরে দুইটি প্রান্তকে (এই দুটি প্রান্তের একটি বেশ বড় এবং অপরটি ছােট থাকবে) দড়ির নিচে স্থির প্রান্তের উপর চাপ দিয়ে ধরতে হবে (চিত্র-ক অনুযায়ী)। সুতাের বড় অংশ দিয়ে ঐ সুতাের ছােট প্রান্ত সহ মূল দড়িকে নিচের দিক থেকে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে উপরের দিকে যেতে হবে (চিত্র-খ অনুযায়ী)

সুতাে দিয়ে মূল দড়িকে প্যাঁচানো শেষ হলে দড়ির প্রান্তকে বাইটের যে অংশ মূল দড়ির শেষ প্রান্তে ছিল তার মধ্যে ঢুকিয়ে সুতাের যে অংশ মূল দড়ির নিচে স্থির অংশের উপর আছে তাকে ধরে টান দিতে হবে (চিত্র-গ অনুযায়ী)।

এভাবে টানলে বাইটের যে অংশ মূল দড়ির শেষ প্রান্তে ছিল তা প্যাচানাে সূতার ভিতরে চলে যাবে। হুইপিং দেয়া শেষ হলে সুতাের যে অংশ বাইরে আছে তা এবং মূল দড়ির প্রান্ত ভাগে যে তন্তুগুলাে বাইরে আছে যেগুলাে সুন্দরভাবে ধারাল কাচি বা চাকু বা ব্লেড দিয়ে কেটে দিতে হবে।

(গ) নিচের গেরােগুলাে বাঁধতে পারা ও তাদের ব্যবহার জানা :

সদস্য ব্যাজ অর্জনের জন্য যে চারটি গেরাে সম্পর্কে আমাদেরকে জানতে হবে :

(১) ওভার হ্যান্ড বা থাম্ব নট (Over Hand or Thumb Knot) : দড়ির এক প্রান্তে একটি লুপ তৈরি করে স্থির প্রান্তটির নিচে এবং চলমান প্রান্তটি উপরে রাখতে হবে । চলমান প্রান্তটি লুপের নিচের দিক থেকে ভিতর দিয়ে উপরে টেনে আনলে সেটাই হবে ওভার হ্যান্ড বা থাম্ব নট । দড়ির শেষ প্রান্তে সাধারণত এ গেরাে ব্যবহার করা হয়।

২. রীফ নট (REEF KNOT) বা ডাক্তারী গেরাে : দুটি সমান মােটা দড়ির মাথা একটি ডান হাতে ও অপরটি বাম হাতে ধরে ডান হাতের দড়ির মাথার কাছে খানিক অংশ বাম হাতের দড়ির মাথার দিকে পাশাপশি ধরে একটি প্যাঁচ দিতে হবে। দড়ির একটি অংশকে সেই অংশের মূল দড়ির পাশে রেখে অপর অংশটি দিয়ে থামের অংশের সাথে প্যাঁচ দিতে হবে। আস্তে আস্তে টেনে গেরাে শক্ত করতে হবে । এইভাবে। রীফ নট বা ডাক্তারী গেরাে বাঁধতে হয়। রীফ নট বা ডাক্তারী গেরাে সাধারণত সমান মােটা দুইটি দড়ি জোড়া দিতে, প্যাকেট বা ব্যান্ডেজ বাঁধতে ব্যবহার করা হয়।

৩. বােলাইন (BOWLINE) বা জীবন রক্ষা গেরাে : দড়ির এক প্রান্তকে ডান হাত দিয়ে ধরতে হবে। বাম হাতের তালুকে উপরের দিকে রেখে দড়িকে বাম হাতের তালুর ওপর রাখতে হবে। দড়ির যে অংশে লুপ তৈরি করতে হবে সে পরিমাণ দড়িকে নিজের শরীরে দিকে টেনে আনতে হবে।

শরীরের দিকে দড়ির যে অংশ আছে সেটি দড়ির চলমান অংশ। এখন দড়ির চলমান অংশ (যা তােমার শরীরের দিকে আছে) দিয়ে হাতের তালুর ওপর এমন ভাবে একটি লুপ তৈরী করতে হবে যেন লুপ তৈরির পর দড়ির চলমান অংশ দড়ির স্থির অংশের উপরে থাকে (ক চিত্র অনুযায়ী)। এভাবে তৈরি লুপকে বাম হাতের মধ্যমা এবং বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে ধরতে হবে । বাম হাতের তর্জনী শরীরের সামনের দিকে বাড়িয়ে দড়ির স্থির অংশকে তর্জনীর উপর রাখতে হবে। দড়ির চলমান প্রান্তটি লুপের নিচ থেকে উপরের দিকে উঠিয়ে দড়ির চলমান প্রান্তকে দড়ির স্থির অংশের নিচ দিয়ে সরাসরি আবার লুপের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হবে (খ চিত্র অনুযায়ী)। এখন লুপের মধ্যে দড়ির চলমান যে দুটি অংশ আছে সে দুটি অংশকে ডান হাতে ধরে দড়ির স্থির অংশ বাম হাতে ধরে টানলে তা বােলাইন বা জীবন রক্ষা গেরাে হয়ে যাবে। এইভাবে বােলাইন। বা জীবন রক্ষা গেরাে বাধতে হয় (ঘ চিত্র অনুযায়ী)। জীবন্ত কোন লােককে উদ্ধারের জন্য যেমন উপর থেকে নিচে নামাবার বা নিচ থেকে উপরে তােলার জন্য বােলাইন বা জীবন রক্ষা গেরাে ব্যবহার করা হয়। পানিতে ডুবন্ত ব্যক্তিকে তুলতে এবং আগুন লাগা ঘর থেকে কোন অচেতন ব্যক্তিকে উদ্ধার করার জন্য এ গেরাে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

৪. ক্লোভ হিচ (CLOVE HITCH) বা বঁড়শী গেরাে : দড়ির চলমান প্রান্ত দিয়ে খুঁটিতে একটি পূর্ণ প্যাঁচ দিতে হবে। এই প্যাঁচ দেয়ার ফলে দড়ির স্থির অংশ দড়ির চলমান অংশের নিচে অথবা উপরে থাকতে পারে। যদি দড়ির স্থির অংশ চলমান অংশের নিচে থাকে, তাহলে দড়ির চলমান অংশকে আগের তৈরি প্যাঁচের নিচ দিয়ে খুঁটিতে ঘুরিয়ে এনে দড়ির স্থির অংশের নিচ দিয়ে দ্বিতীয়বারে তৈরি প্যাচের মধ্যে ঢুকিয়ে । দিতে হবে। দড়ির দু’প্রান্তকে টেনে হিচকে | শক্ত করে দিতে হবে। এভাবে ক্লোভ হিচ বা বঁড়শী গেরাে বাঁধতে হয়।

কোন দড়ির এক প্রান্তকে কোন খুঁটিতে বা পপালে বাঁধার জন্য এবং একমাত্র ডায়গােনাল ল্যাশিং ছাড়া সব ল্যাশিং শুরু ও শেষ করতে ক্লোভ হিচ ব্যবহার করা হয়। সুতার মাথায় বড়শী বাধতেও এই হিচ ব্যবহার করা হয়।


0 0 votes
Article Rating
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Rabby Choudhury
  • কিছু টা ধারণা নিলাম।খুবই ভালো লাগলো।