খ্রিষ্ট ধর্ম

পাপে পতিত মানবজাতির মুক্তির জন্য ঈশ্বর তার পুত্র যিশুখ্রিস্টকে এ জগতে পাঠিয়েছেন। ঈশ্বরের ডাকে সাড়া দিয়ে যারা পরিত্রাণ লাভের জন্য খ্রিস্টকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত | নিয়েছে এবং সেই বিশ্বাসে স্থির ও অবিচল থেকে তার অনুসারী হয়েছে তারা হলাে খ্রিস্টান। আর যিশু খ্রিষ্টের দ্বারা প্রচারিত ধর্মের নাম খ্রিস্টধর্ম।

খ্রিস্টের অনুসারী হওয়ার জন্য প্রয়ােজনীয় গুণাবলী : খ্রিস্ট মানবীয় ও ঐশ্বরিক স্বভাব নিয়ে জন্ম নিয়েছেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে যারা তার অনুসারী হয় এবং তার নির্দেশিত পথে চলে ও বাস্তব জীবনে তার শিক্ষা পালন করে চলে তারাই প্রকৃত খ্রিস্টান হিসেবে চিহ্নিত হয়।

এ সম্পর্কে পবিত্র বাইবেলে বলা আছে –

“অন্তরে যারা দীন, তারা ধন্য-স্বর্গরাজ্য তাদেরই।

দুঃখে-শােকে কাতর যারা, ধন্য তারা-তারাই পাবে সান্ত্বনা ।

বিনীয় কোমলপ্রাণ যারা, ধন্য তারা-প্রতিশ্রুত দেশ একদিন হবে তাদেরই আপন দেশ।

ধার্মিকতার দাবি পূরণের জন্যে তৃষিত ব্যাকুল যারা, ধন্য তারা-তারাই পরিতৃপ্ত হবে।

দুয়ালু যারা, ধন্য তারা-তাদেরই দয়া করা হবে।

অন্তরে যারা পবিত্র, ধন্য তারা-তারাই পরমেশ্বরকে দেখতে পাবে। শান্তি স্থাপন করে যারা, ধন্য তারা-তারাই পরমেশ্বরের সন্তান বলে পরিচিত হবে।

ধর্মনিষ্ঠ বলে নির্যাতিত যারা, ধন্য তারা স্বর্গরাজ্য তাদেরই।

আর ধন্য তােমরা, আমার জন্যে লােকে যখন তােমাদের অপমান করে, নির্যাতন করে, যখন তােমাদের নামে তারা নানা মিথ্যা অপবাদ রটায়। তখন আনন্দ ক’রাে, উল্লাস কারাে তােমরা, কারণ স্বর্গলােকে তােমাদের জন্যে সঞ্চিত হয়ে আছে এক মহা পুরস্কার। তােমাদের আগেকার প্রবক্তারাও তাে ঠিক একই ভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন।”

মিথি ৫৪৩-১২ পদ]।

পবিত্র বাইবেলে আরাে উল্লেখ আছে : যিশুর অনুসারীদের চালচলন আচার-ব্যবহার এবং প্রভুর বাণী প্রচারে উদ্যম ও উৎসাহ দেখে তাদেরকে আন্তিয়ােখ নগরীতেই প্রথম খ্রিস্টান নামে অভিহিত করা হয়। [প্রেরিত ১১৪১৬]।

 প্রার্থনার ও উপবাসের প্রয়ােজনীয়তা : প্রার্থনা হলাে ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে সংলাপ। বা কথােপকথন। প্রার্থনার মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে যােগাযােগ ও গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি । প্রার্থনা কেমন হওয়া উচিত এবং কেমন করে প্রার্থনা করতে হয় সে সম্বন্ধে প্রভু যিশু নিজেই আমাদের শিখিয়েছেন। উপবাস হলাে ত্যাগ স্বীকার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির উপায় । এর দ্বারা আমরা অন্তরের পবিত্রতা এবং ঈশ্বরের সানিধ্য লাভের উপায় খুঁজে তার। প্রিয় সন্তান হয়ে উঠি। এ সম্পর্কে পবিত্র বাইবেলে যীশুর নির্দেশ সুস্পষ্ট।

প্রার্থনার বিষয়ে শিক্ষা : তােমরা যখন প্রার্থনা কর, তখন ভন্ডদের মতাে তা করাে। তারা যত সমাজগৃহে আর চৌরাস্তার মােড়ে মােড়ে দাড়িয়েই প্রার্থনা করতে ভালবাসে, যাতে তারা সকলের নজরে পড়ে। আমি তােমাদের সত্যিই বলছি, তাদের। পুরষ্কার তারা পেয়েই গেছে। যখন তুমি প্রার্থনা কর, তুমি বরং তখন তােমাদের নিজেই ঘরেই যাও, আর দরজা বন্ধ করে তােমার পিতাকেই ডাক, সেই গােপনেই থাকেন যিনি। তাহলে তােমার পিতা, যিনি গােপনে সব কিছু দেখতে পান, তিনি তােমাকে পুরস্কৃতই করবেন। প্রার্থনার সময় তােমরা বিধর্মীদের মতাে অযথা বেশি কথা বলল না। কারণ তারা মনে করে যে, কথার জোরেই তাদের প্রার্থনা পূর্ণ হবে। না, তাদের মত হয়াে না, কারণ তােমরা কিছু চাইবার আগেই তােমাদের পরম পিতা জানেন তােমাদের কী কী প্রয়ােজন আছে। তাই তােমাদের এইভাবে প্রার্থনা করা উচিতঃ হে আমাদের স্বর্গনিবাসী পিতা, তােমার নাম পূজিত হােক, তােমার রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হােক, তােমার ইচ্ছা স্বর্গে যেমন পূর্ণ হয়, তেমনি মর্তেও পূর্ন হােক। আজকের অন্ন আজই আমাদের দান কর । আমরা যেমন অন্যের অপরাধ ক্ষমা করি, তেমনি তুমিও আমাদের অপরাধ ক্ষমা কর । আর আমাদের প্রলােভনে পড়তে দিও না, বরং সেই মহা অসত্যের হাত থেকে আমাদের সর্বদাই রক্ষা কর। (মথি ৬৪৫-১৪ পদ]।

মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য : মানব সৃষ্টির পেছনে ঈশ্বরের মহান পরিকল্পনা ও অভিপ্রায় রয়েছে। সৃষ্টির সেরা জীব তার নিজের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্ট মানুষের দ্বারাই তিনি তার পরিকল্পনা পূর্ণ করেন। একমাত্র মানুষকেই তিনি বেছে নিয়েছেন সৃষ্টসহ সবকিছুর উপর কর্তৃত্ব করতে এবং নিজের ও অপরের কল্যাণে তা ব্যবহার করতে। মানুষকে এত মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করার আর একটি উদ্দেশ্য হলাে সে যেন ঈশ্বরের প্রশংসা ও গৌরবকীর্তন করে। সেজন্য মানুষ পেয়েছে একটি মর্যাদাপূর্ণ অধিকার ও দায়িত্ব। অতএব, সর্বসত্তা দিয়ে সৃষ্টিকর্তার আরাধনা করা, তাকে জানা এবং তার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।

ঈশ্বরের ভালবাসার উপলদ্ধি : যিশু তখন তাদের কাছে এসে বললেন- স্বর্গ ও পৃথিবীতে পূর্ণ অধিকার আমাকে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং যাও, তােমরা গিয়ে সকল জাতির মানুষকে আমার শিষ্য কর; পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার নামে তাদের দীক্ষাস্নাত কর। তােমাদের যা কিছু আদেশ দিয়েছি তা পালন করতে শিখাও। আর জেনে রাখ, জগতের সেই অন্তিমকাল পর্যন্ত আমি সর্বদাই তােমাদের সঙ্গে সঙ্গেই আছি” (মথি ২৮ঃ১৮-২০]। সাধু পল বলেন “তােমাদের মঙ্গলের জন্য আমরা যখন প্রার্থনা করি, তখন আমরা সর্বদাই প্রভু যিশু খ্রিষ্টের পিতা পরমেশ্বরের কাছে ধন্যবাদ জানাই; কারণ খ্রিষ্ট-যিশুর প্রতি তােমাদের যে কতখানি বিশ্বাস আর সকল ভক্তের প্রতি তােমাদের যে কতখানি ভালবাসা, সে কথা আমরা শুনেছি। স্বর্গলােকে তােমাদের জন্যে যা সঞ্চিত রয়েছে, তা পাবার আশাই তােমাদের এই বিশ্বাস ও ভালবাসাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। এই আশার বার্তা তােমরা আসলে সেই তখনই শুনতে পেয়েছিলে, যখন মঙ্গল সমাচারের সত্যময় বানী তােমাদের কাছে প্রথম এসেছিল। মঙ্গলসমাচার এখন সারা জগতে ফলশালী হয়ে উঠেছে, প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে চলেছে ঠিক যেমনটি তােমাদের মধ্যেও সেই দিন থেকেই চলে এসেছে, যেদিন তােমরা পরমেশ্বরের অনুগ্রহের কথা প্রথম শুনতে পেয়েছিলে এবং তার যথার্থ স্বরূপ বুঝতে পেরেছিলে। তখন এই ব্যাপারে তােমাদের শিক্ষাগুরু খ্রিষ্টের এক বিশ্বস্ত সেবাকর্মী। তারই কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি তােমারই অন্তরে স্বয়ং পবিত্র আত্মা কত গভীর ভালবাসাইনা জাগিয়ে তুলেছেন”। (কলসীয় ১৪ ১-৮)

জীবন সাক্ষ্য : “তাই প্রভুর নামে আমি তােমাদের বলছি, জোর দিয়েই বলছি; তােমরা আর বিধর্মীদের মতাে জীবন যাপন করাে না- তারা শুধুমাত্র অসার ধ্যান-ধারণায় চালিত। তাদের মনটা তাে অন্ধাকরে আচ্ছন্ন হয়ে আছে তাদের মধ্যে এমনই অজ্ঞতা রয়েছে, তাদের হৃদয়টা এমনই কঠিন যে, তারা ঐশ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে। তাদের বােধশক্তি লােপ পেয়েছে। উজ্জ্বলতার স্রোতে এমনই গা ভাগিয়েছে তারা যে, অশুচি যত কাজ করতে তারা সর্বদা লােলুপ হয়ে আছে। খ্রিস্টের শিষ্য হয়ে তােমরা তাে সেইভাবে চলতে শেখােনি- অবশ্য তােমরা যদি সত্যই তাঁরই কথা শুনে। থাক- যে সত্য যিশুতেই নিহিত, তাঁর সেই সত্যেরই মন্ত্রে যদি তােমরা দীক্ষিত হয়ে থাক। তােমরা তাে এই শিক্ষাই পেয়েছ যে, তােমাদের আগেকার জীবনযাত্রা ছেড়ে দিতে হবে; জীর্ণ পােশাকের মতােই পরিত্যাগ করতে হবে তােমাদের সেই পুরনাে মানুষটাকে, মােহময় কামনায় ক্ষয়িষ্ণু সেই মানুষটাকে। মনের নব প্রেরণায় নবীন হয়ে তােমাদের বরং পরে নিতে হবে সেই নতুন মানুষটিকে, যে মানুষ সৃষ্ট হয়েছে ঐশ প্রতিরূপে, সত্যের প্রভাবে ধর্মিষ্ট ও পবিত্র এক সৃষ্টিরূপে।

“তাই বলছি, মিথ্যাকে বর্জন করে তােমরা প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিবেশীর কাছে সত্য কথাই বল; কেন না পারস্পরিক সম্পর্কে আমরা তাে অঙ্গপ্রত্যঙ্গেরই মতাে। তােমরা ক্রুদ্ধ হলেও পাপ করাে না যেন। দেখাে, এমনটি যেন না হয় তােমরা রুষ্ট হয়েই আছ, এদিকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। শয়তানকে কিছু করার সুযােগ তােমরা দিও না! চুরি করা যার স্বভাব, সে যেন চুরি না করে; সে বরং কাজ করুক, নিজের দু’টো হাত দিয়ে সে বরং ভাল কিছুই করুক, তাহলে সে তাে তার নিজের থেকে অভাবী মানুষদেরও কিছু না কিছু ভাগ দিতে পারে। তােমাদের মুখ থেকে যেন কখনাে কোন খারাপ কথাবার্তা না বেরােয় বরং মানুষের যা ভাল করতে পারে, প্রয়ােজন মতাে গঠনমূলক কোন কিছু করতে পারে, তােমরা তেমন কথাই বললাে, যাতে যারা শুনছে তাদের যেন কিছু উপকার হয়।

আর একটা কথা : ঈশ্বরের সেই পবিত্র আত্মা যিনি, তাকে তােমরা কখনাে দুঃখ দিয়ে। তােমাদের অন্তরে তিনি তাে সে ঐশী যে মুদ্রাঙ্কনে তােমরা চিহ্নিত হয়েছ পূর্ণ মুক্তি লাভের সে দিনটির জন্যে । তােমারে মধ্যে কোন তিক্ততা, কোন রােষ-আক্রোশ রেখাে না; কোন কটু কথা, কোন ক্রুদ্ধ চিকার, কোন রকম অনিষ্ট কামনা আর নয় । তােমরা একে অন্যের প্রতি সহৃদয় হও, হও কোমল প্রাণ । পরস্পরকে তােমরা ক্ষমা করে নাও, যেমন খ্রিষ্টে তােমাদের আশ্রয় দিয়ে পরমেশ্বরও তােমাদের ক্ষমা করেছেন। (ইফসীয় ৪ ১৭-৩২)

“তােমাদের কথা মনে পড়লেই আমি আমার ঈশ্বরের কাছে ধন্যবাদ জানাই; আর সব সময়ে, তােমাদের সকলের জন্যে যখনই আমি তাকে ডাকি, তখনই সেই প্রার্থনায় আমি একটা আনন্দ অনুভব করি; কেননা মঙ্গলসমাচার প্রচারের কাছে তােমরা প্রথম দিন থেকে আজও পর্যন্ত আমার সঙ্গে সহযােগিতা করেই আসছ। আর আমি তাে এই বিষয়ে নিঃসন্দেহ যে, তােমাদের অন্তরে যিনি এই শুভ কাজটি শুরু করেছেন, তিনি নিজেই খ্রিষ্ট-যিশুর সেই মহা দিনটি পর্যন্ত তা করে গিয়ে সুসম্পন্ন করে তুলবেন।

তােমাদের সকলের সম্বন্ধে আমার এ ধরনের মনােভাব থাকাটা নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক নয়; তােমরা তাে সর্বদা আমার হৃদয় জুড়েই রয়েছ; কেননা আমি কারাগারেই পড়ে থাকি, কিংবা মঙ্গল সমাচারের সপক্ষে উঠে দাড়িয়ে তার সত্যতা প্রতিপন্নই করে থাকি, যে অবস্থাই থাক না কেন, তখন তােমরা সকলেই তাে আমার। সঙ্গে একই ঐশ অনুগ্রহের অংশীদার হয়ে থাক। পরমেশ্বর আমার সাক্ষী যে, তােমাদের আমি একান্তভাবেই কাছে পেতে চাই; আমার অন্তরে স্বয়ং খ্রিষ্ট যিশুর স্নেহ নিয়েই তােমাদের কাছে পেতে চাই। আর আমি এই প্রার্থনাও করি যে, তােমাদের ভালবাসা যেন গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠে আর সেই সঙ্গে তােমরা যেন সত্যিকার জ্ঞান ও পরিণত বােধশক্তিও লাভ করতে পার। যাতে তােমরা, যা কিছু শ্রেয়, তা যেন চিনে নিতে পার। তাতেই তােমরা অমলিন অনিন্দনীয় হয়ে খ্রিষ্টের সেই মদিনটির জন্যে প্রস্তুত হয়ে উঠবে; তােমাদের অন্তর ভরে থাকবে ধার্মিকতার সেই ফসলে, স্বয়ং যীশু খ্রিষ্টই যা ফলিয়ে তােলেন, যাতে বিরাজিত হয় পরমেশ্বরের মহিমা, ধ্বনিত হয় তাঁর স্তুতিবন্দনা”। [ফিলিপীয় ১৪৩-১১]


0 0 votes
Article Rating
guest
69 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments